সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

'রি কেজেচা' (রি লং পোয়ে বা জলকেলি)

সম্ভবত ২০০৪ সালে খাগড়াছড়িতে প্রথমবারের মতো 'রি কেজেচা'(রি লং পোয়ে বা জলকেলি) অনুষ্ঠিত হয় তৎকালীন বিএমএসসি খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির মাধ্যমে। 'সম্ভবত' এ কারণে বলছি যে, কেউ কেউ ২০০৭-২০০৮ বলে দাবি করছে। এখন যদিওবা মারমা উন্নয়ন সংসদ (মাউস) এ 'রি কেজেচা' আয়োজন করছে, ৭-৮ বছর আগেও শুধুমাত্র এ খেলাটি বিএমএসসি জেলা কমিটি আয়োজন করত। আমি স্বয়ং এ খেলার আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। কখন, কবে, কোথায় থেকে এ 'রি কেজেচা' খেলাটি উদ্ভব হয়েছে, সেটা না জানলেও এইটুকু জানতাম যে, সাংগ্রাইং এর দিনে সকালে মাউস থেকে একটা র্যালি বের হয়। সেই র্যালি শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা প্রদক্ষিণ করে যে জায়গায় শেষ হয় সেই জায়গায় 'রি কেজেচা' হয়। যদিওবা মারমা ঐক্য পরিষদ নামে আরেকটি সামাজিক সংগঠনও এ 'রি কেজেচা' খেলাটি আয়োজন করে থাকে। এ পরিষদ কবে থেকে এ খেলাটি আয়োজন করেছে, তা জানা নাই।

এ খেলাটি কবে, কখন খেলতে হয় তা জানতাম না। শুধু এইটুকু জানতাম, সাংগ্রাইং দিনে র্যালির শেষে খেলা হয়। দুইটি টীম থাকে। যুবক ও যুবতী।  দুই টীম দুই পাশে থেকে তার সামনে থাকা অপর টীমের সদস্যকে পানি ছুঁড়ে মারতে হয়। কোনভাবেই হাত দিয়ে মুখ মোছা যাবে না। যে হাত দিয়ে মুখে জল মুছবে সেই খেলতে পারবে না। মানে পরাজয় হবে। তারপর একটি দল জয়ী হবে পরে। শেষে ওই দুইটি দল থেকে একটি দল হাঁটু গেড়ে বসে থাকবে। আর আরেকটি দল দাঁড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা দলের সদস্যদের পানি ছিটাবে। এরপর দাঁড়িয়ে থাকা দলটিও বসে পড়বে। আরেকদল দাঁড়িয়ে পানি ছিটাবে। এই ছিল তখনকার জানা এ 'রি কেজেচা' খেলার নিয়মকানুন। পরবর্তীকালে বিএমএসসির নেতাকর্মীদের হাত ধরে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন অঞ্চলে এ খেলার প্রচার ও প্রচার ঘটে। অনুষ্ঠিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিবাসীদের সাথে মেলামেশার ফলে জানতে পারি তাদের এ 'রি কেজেচা' খেলাটি সাংগ্রাইং এর দিনে খেলা হয় না। সাংগ্রাইং এর পরের দিন অর্থাৎ আক্যে দিনে 'রি কেজেচা' খেলা অনুষ্ঠিত হয়। সাংগ্রাইং এর দিনে তারা (শিশু, ছেলে-মেয়ে,যুবক-যুবতী, বয়স্কসহ সবাই) বিহারে গিয়ে ধর্মকর্ম করেই কাটিয়ে দেয়। বুদ্ধ স্নানের আগে 'রি কেজেচা' খেলাটি হয় না। এমনও নাকি মিথ আছে, বুদ্ধ স্নানের আগে 'রি কেজেচা' খেলা খেললে নাকি পাপ হয়। ২০০৪ সালের আগেও খাগড়াছড়িতে একই অবস্থা ছিল। কিন্তু এ 'রি কেজেচা' খেলা প্রচলন হবার পরে যুবক-যুবতীরা যায় এ খেলায়, আর শুধু বয়স্করা বিহারে যায়।

আর খাগড়াছড়ি সদরে এখন দুই টীম করে দুই পাশে নৌকায় বা ড্রামে রাখা পানি থেকে একে অপরের টীমের দিকে পানি ছিটানোর চেয়ে একটা জায়গায় জড়ো হয়ে নাচাটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। একই সাথে বিভিন্ন গানের গায়ক-গায়িকারা গান গাইছে। সেই তালে নাচা হচ্ছে। বাইরে থেকে মোটরের সাহায্য বড় পাইপের মাধ্যমে জড়ো হওয়ার দিকে পানি ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। আগে পানি খেলা, জলকেলি বা পানি বর্ষণ (মারমা ছাড়া অন্য ভাষাভাষী যেমন করে বলে) বলতে বুঝতাম, দুই টীম করে পানি খেলা। আর এখন পানি খেলা বলতে বুঝি একটা জায়গায় জড়ো হয়ে সাউন্ড বক্স থেকে বাজা কোন গানে তালে তালে নাচা ও বাইরে থেকে বড় পাইপে করে পানি ছুুঁড়া।

খাগড়াছড়ি সদরে এখনও যে জায়গায় 'রি কেজেচা' হয়, সেই জায়গায় বাঙালিদের এলাউ করা হয় না। এতদিন সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই প্রাইভেসি আর থাকল না। কিছু ভ্লগার খুব কাছ থেকে ভিডিও করে নিজেদের পেইজে আপলোড দেয়। যে প্রাইভেসি এতদিন ছিল, ভিডিও করে আপলোড দেওয়ার ফলে সেই প্রাইভেসি থাকল না আর। একটা মেয়ে টীম দেখলাম এ 'রি কেজেচা'তে আসছে। তবে গামছা বা ওড়না টাইপের কিছু একটা বুকে দিয়ে। তারা জানে, তারা যখন নাচবে, শরীর ভিজে যাবে, তখন ভ্লগাররা ভিডিও করবে। তাই বুক ঢাকানোর জন্য তারা এক্সট্রা কাপড় নিয়ে আসছে। এটা যে আমাদের সংস্কৃতির জন্য কত বড় আঘাত, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

ডিবিসি নিউজে একটা প্রতিবেদন দেখলাম সেখানে ভেজা শরীরে রাখাইন মেয়েরা নাচছে। আর সেই ভেজা  শরীরের পশ্চাদ্দেশের দিকে ক্যামেরা তাক করে বারবার দেখাচ্ছে। সাংবাদিক লুলুপ দৃষ্টিতে করছে। প্রায় ১৪ সেকেন্ড ধরে কোন প্রকার ভাষ্য ছাড়া ভেজা শরীর (মূলত মেয়েদের পশ্চাদ্দেশ) দেখিয়েছে। আর ১৮ সেকেন্ডে গিয়ে একজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। আর ক্যাপশন দিয়েছে ‘পানি খেলার উৎসব দেখে খুব মজা লাগছে’। অন্যদিকে লামায় 'রি কেজেচা' অনুষ্ঠানে বাঙালিরাও খেলছে, দুইজন বাঙালি ছেলে পাহাড়ী মেয়ের দিকে পানি ছুঁড়ছে। যে উৎসব শুধুই আমাদের, যে উৎসবের প্রাইভেসি শুধুই আমাদের, সেখানে ভিডিও ভ্লগাররা ভিডিও করে নেটে ছেড়েছে, সাংবাদিকেরা সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি নিয়ে ভিডিও করে প্রতিবেদন বানাচ্ছে, এটা আমাদের নিজস্বতার, রক্ষণশীলতার প্রতি আঘাত।

......................................

খাগড়াছড়ি মাংদ্রাচু (মানিকছড়ি) এর মারমা একটি গ্রামের দুটি পাড়ায় দুইবার কনসার্ট হয়েছে সাংগ্রাইংকে উপলক্ষ করে। যে সাংগ্রাইং এ দহ্ ও খোঞাং খেলার মাধ্যমে আনন্দের আমেজ আনয়নের, পাংখুং মঞ্চস্থ করে মিলনমেলা তৈরিকরণের ও পুরাতন বছরের দুঃখ-গ্লানি-বিষাদ ভুলে সামনের দিনগুলোতে এগোবার, সেই সাংগ্রাইং এখন মেলা অনুষ্ঠানের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতার, অযাচিত ব্যয় করবার ও সমিতি থেকে ধার করবার উৎসব হয়ে গেছে।

সাংগ্রাইং উৎসব নিয়ে আমাদের সবার ভাবনায়ও এমন কতগুলো চিন্তা-ভাবনার ঢেউ খেলে যায় কি? কিংবা সাংগ্রাইং উৎসব নিয়ে আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে, এমন চিন্তা-ভাবনা আসে কিনা? বা আসবে কি?

Post a Comment

0 Comments