সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

খাগড়াছড়ি ভিক্ষুসংঘের বিভক্তি ইতিহাস

প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। তখন মারমা ভিক্ষুদের মধ্যে একটামাত্র সংঘ ছিল। সেই সংঘের ভিক্ষুরা  প্রাচীনকাল থেকে পালন করে আসা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-আচরণ সুচারুভাবে পালন করতেন। যেমন, গ্রামের কোন দায়ক-দায়িকা মারা যাওয়ার পর শবদাহকে  শ্মশানে নিয়ে গেলে ভিক্ষুরাও শবের পেছনে শ্মশানে যেতেন। তারপর রগ্যইং বুচা (বাঁশটাকে দা দিয়ে কেটে গ্লাসের মতো করে সেখানে পানিতে হলুদের টুকুরা দিয়ে বানানো এক প্রকার গ্লাস), কাইং তুচা (শবাদারের পাশে ছোট পুকুর খনন করা হয়),  খ্রি ঙাচা (শবাদারকে ঘিরে সুতা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়, এ সুতাকে নিয়ে পরে পাঁচটা প্যাঁচ - মেয়ে হলে, সাতটা প্যাঁচ - ছেলে হলে হাতে পরা হয়) এসব ধর্মীয় কতগুলো দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অনুষ্ঠান-আচারাদি পালন করা হয়।

তখন কসাহ্লা ভান্তে নাকি এক ভান্তে ছিলেন। তিনি খাগড়াছড়ি সদরে স্বনামধন্য এক বিহারে বর্ষাবাস করেছিলেন। তিনি পরিণত বয়সে ভিক্ষু জীবন গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ধর্মীয় বিষয়ে আরও জ্ঞান অর্জনের জন্য সূদুর মিয়ানমার যান। সেখান থেকে শিক্ষাদীক্ষা লাভের পর ফিরে আসেন খাগড়াছড়িতে। যখন তিনি খাগড়াছড়িতে এসে বসবাস করতে শুরু করেন, তখন তিনি উপরিউক্ত ধর্মীয় রীতিনীতি মানতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি যুক্তি দেখান যে, মিয়ানমারে গিয়ে ধর্মকে নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি কিন্তু ধর্মীয় বই ও ত্রিপিটকের কোথাও মৃত দেহকে নিয়ে এ ধরণের রীতিনীতি উল্লেখ নাই এবং এ ধরণের রীতিনীতিই বরং ধর্মবিরুদ্ধ। তাই তিনি মৃত দেহকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় শ্মশানে যান নাই। তারপর শ্মশানে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-আচরণ তিনি মানতে নারাজ ছিলেন। ফলে কোন কোন গ্রামে এসব রীতিনীতি মানা হয় নাই। তাঁর সহকর্মী ও শিষ্যবৃন্দ এসব রীতিনীতি উপেক্ষা করতে শুরু করেন।

তখন মারমা বৌদ্ধদের মধ্যে স্পষ্টত দুইভাগ হয়ে পড়েছিল। মৃতদেহে শেষকৃত্যের সময় ধর্মী কর্মসম্পাদন নিয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন ভিক্ষুরা। একদল আহ্রী (লম্বা), আরেকদল আটো(বাইট্ট্যা)। আহ্রী (লম্বা) ভিক্ষু মানেই হচ্ছে আগের রীতিনীতি মানা ভিক্ষুসংঘ অর্থাৎ তাঁরা মৃতদেহকে ঘিরে দীর্ঘ (লম্বা) সময় ধরে আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। তাই তাঁরা লম্বা ভিক্ষু। এঁদেরকে প্রাচীনপন্থীও বলা হয়। এবং আটো (বাইট্ট্যা) ভিক্ষু হচ্ছে তাঁরাই যাঁরা আগের রীতিনীতি মানেন না। খুব সংক্ষিপ্ত করেই মৃতদেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। তাই তাঁরা বাইট্ট্যা ভিক্ষু। এঁদেরকে সংস্কারপন্থীও বলা হয়। মূলত কসাহ্লা ভান্তের হাত ধরে মারমা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে ফাটল ধরে যায়। এবং এখন মারমা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পাঁচ ভাগে (গইং) বিভক্ত। 

সবচেয়ে মজার বিষয় হল, এ কসাহ্লা ভান্তে পরবর্তীতে ভিক্ষু জীবন ত্যাগ করে এক নারীকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে🥴! এখন বুদ্ধ মূর্তি বা ভাস্কর্য তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। কিন্তু তার কার্যক্রমের ফসল এখনও লম্বা-বাইট্ট্যা আছে।

সবচেয়ে আশার কথা এ , গুইমারা বথিবাং তংজইং এ অনুষ্ঠিত এক ভিক্ষুর অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় প্রাক্তন চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর উদ্যোগে এবং নতুন প্রজন্মের প্রগতিশীল ভিক্ষুদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ পাঁচটি গইং এর ভিক্ষুরা (বা তাঁদের প্রতিনিধি) ২০২১ সালে একই মঞ্চে বসে ধর্মদেশনা করেছেন। এটি প্রথমবারের মতো মতো ঘটনা ঘটেছে যেখানে সকল গইং থেকে ভিক্ষুরা ছিলেন। ধর্মপ্রাণ দায়ক-দায়িকাদের মনে একটু হলেও আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, এবার বোধহয় ভিক্ষুদের সম্মিলন হতে চলেছে।

আমরা আটো (বাইট্ট্যা) ভিক্ষুদের গইং এর অনুসারী। অর্থাৎ আমাদের পাড়ার বিহারে যে ভিক্ষুরা থাকেন, তাঁরা আটো ভিক্ষুসংঘের। তাই স্বাভাবিকভাবে পাড়াবাসী আটো ভিক্ষুদের অনুসারী। তবে আমরা সব ভিক্ষুকে শ্রদ্ধা করি। সব গইং এর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাই। আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা নাই। আটো গইংকে এ যাবতকালে উদারপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ আটো ভিক্ষুরা সব পক্ষ থেকে ফাং (নিমন্ত্রণ) পেলে যান। সবার সাথে বসতে কোন সমস্যা নাই। এবং খুশীর খবর এ,  আটো অনুসারী হওয়ার পরও আমাদের পাড়ার কোন দায়ক-দায়িকা মারা গেলে সেই আগের রীতিনীতি পালন করা হয়। আটো ভান্তেরাও আসেন। পালন করেন। রিগ্যইং বুচা, খ্রি ঙাংচা, কাইং তুচা এগুলো সুচারুভাবে পালন করা হয়। কিন্তু অন্য গইং এর ভিক্ষুরা সবার সাথে বসেন না। অন্য গইং এর ভিক্ষুদের সাথে সম্পর্ক নাই। তাঁদের আলাদা যুক্তি থাকতে পারে।

........................................

সম্প্রতি বাড়িতে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হওয়াকে কেন্দ্র করে অনেককে ধর্মপ্রাণ দায়ক-দায়িকাদের বলতে দেখেছি। এক ভিক্ষু লাইভে এসে বাড়িতে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হওয়ার সপক্ষে ত্রিপিটকের রেফারেন্সসহ আরও কতগুলো বিষয় বললেন। ত্রিপিটকে কোথাও লেখা নাই যে, বাড়িতে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান হওয়া যাবে না, এমনটিও বললেন। আমরা ছোটবেলা থেকেই জানতে পেরেছি, কঠিন চীবর দান বিহারে হয়। সেটা যেহেতু গ্রামের সবার অংশগ্রহণে হয়, সবার সহায়তায় হয়, ফলে সবার অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে। বছরে অন্তত এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কারণে অনুষ্ঠানটি মিলনমেলায় পরিণত হয়ে ওঠে। ধনী-গরিব সবাই মিলে-মিশে একাকার হয়। ধর্মটাও যেহেতু সবার জন্য, জাত-পাত নির্বিশেষে। 

আমার আশঙ্কা একটা জায়গায়। যদি কঠিন চীবর দান বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে এতদিন ধরে চলে আসা রীতিনীতি হারিয়ে যাবে। যাদের অর্থকড়ি আছে তারা হয়তো এ কঠিন চীবর দান করতে পারবে, যাদের অর্থকড়ি নাই তারা করতে পারবে না। ফলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানও দিনশেষে ধনীদের হয়ে যাবে, যা ধর্মের শুভ লক্ষ্মণ নয়।

ত্রিপিটকে নাই বা ধর্মীয় বইয়ে লেখা নাই বলে এতদিন ধরে পালন করে আসা রীতিনীতিকে লঙ্ঘন করাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, আমার বুঝে আসে না। অন্তত আমি মানতে পারি না। ধর্ম স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তন হবে। এবং সেই পরিবর্তনটাও যেন দায়ক-দায়িকাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে হওয়া উচিত। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় এ, যদি এটিকে কেন্দ্র করে ভিক্ষুসংঘে আবার ফাটল ধরে! আমরা ঘর পোড়া গরুর মতো, সিঁদুরে মেঘ দেখলে আমাদের ভয় হয়। কারণ আমাদের তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভক্ত হওয়ার ইতিহাস আছে।

মারমাদের জীবনাচারে বিশাল অংশ জুড়ে আছে ধর্ম। এ ধর্মেও যদি এতটা ফাটল ও দ্বন্দ্ববিবাদ থাকে, তাহলে ধর্মপ্রাণ দায়ক-দায়িকারা কোথায় যাবে?

Post a Comment

0 Comments