সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

 অনুচ্চকন্ঠে মারমা বিদ্রোহ

‘মাঙলং অং খইং’ নামে এক মারমা কিংবদন্তী বিদ্রোহী নেতা ছিলেন। আনুমানিক উনিশ শতকের গোড়ার দিকে সম্ভবত রখইং ওয়া (রোয়াংছড়ি) এর 'গ্রোওয়াই-উহ্ গ্রামে তাঁর জন্ম। ‘মাঙ’ অর্থ রাজা আর ‘অলং’ অর্থ বিশেষ গুণাবলি আয়ত্তের সময়ে অবস্থা। এটি যুক্ত হয়ে ‘মাঙ লং’ নাম হয়। ‘অং খই’ হল তাঁর কোষ্ঠী নাম। সম্ভবত তিনিই বৃটিশ সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘মাঙলং অং খইং’ একজন অবস্থাপন্ন ‘য়া লুসা’ (জুমচাষী) ছিলেন। 


পরবর্তীতে তিনি বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মানসে স্থানীয় লোকদেরকে সংগঠিত করেন। রাজ-পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয় তাঁর নেতৃত্বে। তখনকার দিতে যুদ্ধাস্ত্র যেমন, দা, তলোয়ার, বর্শা, গাদাবন্ধুক, কুড়াল তৈরি সহ সৈন্যসামন্ত গড়ে তোলা হয়। রাজ পরিচালনা পর্ষদ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে ‘রাজা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে রাজ অভিষেক সম্পন্ন করে। বর্তমান 'গ্রোওয়াই উহ্' গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে  'রিগ্রইং খ্যং' (এটির অর্থ স্বচ্ছ পানির নদী, যেটিকে বাঙালিরা নাম দিয়েছে শঙ্খ নদী আর ইংরেজরা বলে সাঙ্গু নদী) এর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে বড় পাহাড়ে ছিল তাঁর দূর্ভেদ্য দূর্গ। মং পাইং’কে  ‘চয়ব্রাং' (সেনাপতি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। 


তখনকার দিনে বৃটিশরা পাহাড়িদের অত্যাচার ও শোষন করত। তিনি বৃটিশ সরকারের ধার্য্যকৃত সকল প্রকার কর প্রদান বন্ধ করতে জনগণকে আহ্বান করেছিলেন। পরবর্তীতে ‘মাঙলং অং খইং’ দুজন সরকারি কর্মকর্তাকে (বৃটিশ হবে সম্ভবত) গ্রেফতার করেন এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ অর্থাৎ ভয়ভীতি প্রদর্শন করে কর আদায় এবং নারী ধর্ষণের প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের দুজনকে  ‘ফলং খ্যং ও রিগ্রইং খ্যং’ দুই নদীর মিলনস্থলে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তারপর থেকে ছোট নদীটির নাম 'ফলং খ্যং' নামে পরিচিত পায়। মারমা ভাষায় ‘ফলং’ অর্থ বৃটিশ সরকারি কর্মকর্তা আর ‘খ্যং’ অর্থ নদী।


‘মাঙলং অং খইং’ এর নেতৃত্বে রুমা থানায় প্রথম সফলভাবে অভিযান চালানো হয় । তাঁর নির্দেশে সারাদিনব্যাপী অভিযানে চয়ব্রাং মং পাইং রুমা থানা সম্পূর্ণরুপে দখল করেন। তারপর বৃটিশ সরকারের পতাকা নামিয়ে দিয়ে ‘মাঙলং অং খইং’ তাঁর নিজের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পতাকাটির আয়তকার ছিল। গাঢ় লাল রঙের পতাকাটি বেশ কয়েকদিন উত্তোলিত ছিল বলে জনশ্রুতি আছে।  বৃটিশ সরকারকে কর দিতে অস্বীকৃতি, রুমা থানাকে দখল, কতগুলো বৃটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেওয়া, বৃটিশ সরকারের সকল নির্দেশ অমান্য করে আলাদা রাজ্য করার খবরটি বৃটিশ সরকার জেনে যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন উৎস থেকে ‘মাঙলং অং খইং’ এর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এ বিদ্রোহ


দমনের জন্য বৃটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন Superintendent Hutchinson কে তখনকার বোমাং রাজা ‘মাঙলং অং খইং’ এর যাবতীয় তথ্যাবলি একটি পত্র মারফত জানিয়ে দেন। তারপর Hutchinson এর নেতৃত্বে ৬০ জন পুলিশ ও আর্মি ‘মাঙলং অং খইং’ এর বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হলে ‘মাঙলং অং খইং’ এর সৈন্যরা অ্যাম্বুশ করার জন্য প্রস্ততি নিয়ে থাকে। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে ‘মাঙলং অং খইং’ কোন যুদ্ধ করেননি। তাঁকে সৈন্যসামন্তসহ গ্রেফতার করা হয়। অনেকে পালিয়ে যায়। পরে বৃটিশ সরকার বিচার করে অপরাধী ঘোষণা করে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়।  


দুইদিন আগে কাইংসা খ্যং (কর্ণফুলী নদী) এর উপর নৌবিহার করেছিলাম। মারমারা ‘কাইংসা খ্যং’ বলে। কর্ণফুলী বাঙালিদের দেওয়া নাম। ‘কাইংঃ’ অর্থ নদীর পাড় আর ‘সা’ অর্থ মনোরম দৃশ্য। অর্থাৎ এ নদীর  দুই পাড়ের মনোরম দৃশ্য ছিল বলেই এ নদীর নামকরণ হয়েছে ‘কাইংসা খ্যং’। 'কাইংসা খ্যং' এ নৌবিহার চলাকালে উপরিউক্ত ইতিহাসের কাহিনীগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এতদিন জানতাম, মারমাদের অনেক কিছু আছে। শুধু মারমাদের বিদ্রোহী কেউ নেই বা মারমারা ভীতু জাতি বলেই জানতাম। তখন হীনমন্যতায় ভুগতাম। আমরা শুনেছি, সাওঁতাল বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ। কিন্তু কোনকালেই শুনিনি মারমা বিদ্রোহের কাহিনী। এ বিদ্রোহের কাহিনী পড়ার পর মনে হল, হ্যাঁ, আমাদেরও বিদ্রোহের কাহিনী আছে।  আমরাও কোন না কোন বিদ্রোহী ও শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কোন ব্যক্তির উত্তরসূরী। যদিওবা এসব ছোট ছোট ঘটনাগুলো ইতিহাসের স্থান পায়নি। 


কিন্তু ইতিহাসের বাঁকে, কোন এক সময়ে এ ঘটনায় কিছু মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, কিছু মানুষের সক্রিয়তা ছিল, এগুলো যে ইতিহাসের অংশ হতে পারে, সেটা সামাজিক ইতিহাসবিদেরা প্রথম বলতে চেয়েছিলেন। তাই এ ইতিহাস কোনভাবে একটি ছোট ঘটনার নয়, বরং একটা জাতিগোষ্ঠীর গৌরবেরও বটে।  আজ ‘মাঙলং অং খইং’ নেই। তাঁর বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ আমাদের রক্তে নতুন করে সঞ্চারন করতে হবে। ইতিহাস শুধুমাত্র অতীতে ঘটে যাওয়া কাহিনী নয়, ফেলে আসা কোন স্মৃতি নয়। বরং ইতিহাস মানেই বর্তমানতা। তাঁর বিদ্রোহের কাহিনীগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁকে নতুন করে পুনর্জীবন দিয়ে আমাদের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। এ ইতিহাস মারমাসহ স্বল্প সংখ্যার জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই আমরা টিকে থাকব। এ ইতিহাসই আমাদের অনাগত দিনগুলোতে খোরাক জোগাবে। 


[এ ‘মাঙলং অং খইং’ কিংবদন্তী ইতিহাসের মূল উৎস- বোমাং রাজপূন্যাহ ১৯৯৪ উপলক্ষে পইংজ্রা স্মরণিকা, চাই সুই হ্লা নামে একজন এটি লিখেছিলেন এবং সাভাইং মগ’কে নিয়ে লেখা ‘চাবাই মগ’ বই, যেটি অংসুই মারমা লিখেছিলেন।]

Post a Comment

0 Comments