বাম সংগঠনের প্রতি আমাদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। মার্কসবাদ মুক্তিদায়ী দর্শনের কথা বলে। একেবারেই শোষিত ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর কথা বলে। তারপরও স্বল্প জনসংখ্যার প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের মার্কসীয় দর্শন অর্থাৎ মুক্তিদায়ী দর্শনকেও কিছুক্ষেত্রে আঘাত করতে হয়। সাম্যের চর্চায় সকলকে একই কাতারে বাসিন্দা ভেবে সাম্যবাদী এ দর্শন সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে ঠিকই। তবে এতে সবচেয়ে মার খায় আমাদের জনগোষ্ঠী। প্রবল কন্ঠস্বরের নিচে আমাদের যে স্বর, সেই স্বর চাপা পড়ে যায়। ফলে খুব সূক্ষ্মভাবে দর্শনের কথা বলে এসিমিলেশন করে ফেলে, যা আমাদের পক্ষ থেকে বড় অভিযোগ। জীবনমুখী দর্শনের দাবিদার হিসেবে এ মার্কসবাদের অবস্থান আমাদের খুব কাছের। ফলে এ মার্কসবাদের ধ্বজাধারীরাও আমাদের খুব কাছের বলে এ দর্শনের প্রতি আমাদের দূর্বলতা আছে।
প্রসঙ্গ দিয়াত মাহমুদ শাকিল। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন বলে জানা যায়। আমার সাথে এড ছিলেন। কিন্তু কোনদিন কথা হয়নি। কীভাবে যে এড হল সেটাও আশ্চর্যের! ছোটভাইদের কাছ থেকে শুনেছি, তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। চেয়ারম্যান, ইউএনও, ডিসি হয়ে লবিং করেছিলেন। প্রথমে হয়তো কেউ সাপোর্ট করেনি। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে পেরেছিলেন। পাহাড়ীদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তিনি বৌদ্ধ দর্শনের প্রতি অনুরক্ত। তাই তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে চান এবং বুদ্ধ ধর্মকে জানার ইচ্ছে থেকেই তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়েছিলেন।
কিন্তু বুদ্ধের দর্শনকে জানতে এবং বুদ্ধের উপদেশ মানতে ভিক্ষু হওয়ার দরকার নাই, এটা আমাদের হয়তো অনেকেরই অজানা। আমি এমনও দেখেছি, অনেক বাঙালিই, যে ধর্মের হোক না কেন, বুদ্ধের ছবি বা মূর্তিকে তাঁদের রুমে বা বাসায় রেখেছেন। বুদ্ধকে নিয়ে কতগুলো বই তাঁদের তাকে আছে। এবং কথায় কথায় বুদ্ধের বাণী বা দর্শনের কথা বলেন অনেকেই। ফলে বুদ্ধ কারো একক সম্পত্তি নয় এবং কারো বাপের সম্পত্তিতে বুদ্ধকে পরিণত করার চেষ্টাও অযৌক্তিক। কারণ বুদ্ধ সার্বজনীন। বুদ্ধ সবার।
শাকিল আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেল। একজন মানুষ হিসেবে সকল মৃত্যুই আমাকে পীড়া দেয়। মরে গেছে বলেই তাঁর গুণকীর্তন করে যাব, সেই মানুষটিও আমি নই। তিন-চার বছর আগে থেকেই শাকিলকে চিনি যদিওবা মুখোমুখি কখনই দেখা হয়নি। তবে ছোটভাই ও বন্ধুদের কাছ থেকে জেনেছি, তিনি সবচেয়ে পাহাড়ীদের কাছে থেকেছেন। আমাদের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমাদের কন্ঠস্বরকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। ফলে আমাদের ভাই-বোনেরা আমাদের সহযোদ্ধা ভেবে বসেছিলেন। এ ভেবে বসাটাই অমূলক নয় কোনভাবেই। একটা মানুষ এতকিছু যদি আমাদের করে দেখিয়েছেন, তাঁকে সহযোদ্ধা ভাবাটাই ভুল কিছু নয়।
যুগান্তর পত্রিকায় অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেল, শাকিল পাহাড়ী মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করেছিলেন। কতটুকু সত্য মিথ্যা জানি না। আমি আমার মতো করে খোঁজ নিয়ে দেখলাম নিউজটা অনেকটা সত্য। ফলে তাঁর বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে চাওয়াটাতে যে দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য আছে, সেটা পরিস্কার হয়ে যায়। এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, তিনি পাহাড়ীকে বিয়ে করার জন্যই বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়েছিলেন। এজন্য অনেক পাহাড়ীদের সাথে মিশেছেন। পাহাড়ীদের একজন হয়ে উঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁর মতলব অন্য কিছু, সেটা আমরা পরে টের পাই। দিনশেষে অন্য সব বাঙালি (সবাই না) এর মতোই বাম সংগঠনের এ কর্মীও পাহাড়ী মেয়েকে বিয়ে করার ফ্যান্টাসি থেকে আমাদের একজন হতে চেষ্টা করেছিলেন। প্রায় হয়েও গিয়েছিলেন। আমি আগে থেকেই তাঁকে সন্দেহ করেছিলাম এবং তাঁর মৃত্যুর খবর পরেও আমি কোনকিছু বলিনি বা লিখিনি। দেখলাম, অনেকে তাঁকে দেবতার আসনে বসিয়ে দিয়েছে।
শুধু এ শাকিল নাকি! আরও বেশ কয়েকজন আছে এমন। খাগড়াছড়ির বাম সংগঠনের এক পাহাড়ী মেয়েও সংগঠন করার সুবাদে বাঙালিকে বিয়ে করেছে। এমন কয়েকজনকে শুনেছি। যতই যাই বলুক, যাই করুক, যাই দর্শন হোক, দিনশেষে ক্ষতিটা আমাদের হয়। যে দর্শন নিয়ে পাহাড়ে আসুক না কেন, দিনশেষে ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হই। পাহাড়ীরা নিজেরাই নিজেদের মুক্তিদাতা, অন্য কেউ এসে মুক্ত করবে না এটা ভুলে যায়। ফলে বাঙালির কেউ আমাদের পক্ষে কথা বললেই আমরা ভগবান ভেবে স্থান দেই।
রিয়াজ বাঙালি নামে একজন ছিল। পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরত। সকল বয়সী মহিলাদের আলিঙ্গন করার ছবি দেখতাম। হুক্কা টানতে দেখছি। পাহাড়ি সাজতে দেখতাম। আমাদের পক্ষে কথা বলত। দিনশেষে পাহাড়ী মেয়েকে প্রেম করার চেষ্টা, নগ্ন ছবি দেখার চেষ্টা আমরা জেনেছি। ভিডিও কলে নিজের গোপন অঙ্গ দেখাত সে। পাহাড়ী ছেলেদেরও সিডিউস করত সে। গে এর মতো আচরণ করত। মূলত বাইসেক্সুয়াল ছিল সে। অনেকে সেই সময়ে খবর আমার কাছে আসত। হয়তো অনেকে জানত না, এখন তার ব্যাপারে জানত। তার আগে মাছুম নামে স্বঘোষিত কবি ছিলেন। পাহাড়কে নিয়ে বোধহয় কবিতাও ছিল তাঁর। বাঙালিকে বেজাতি বলায় সেদিন ক্ষেপেছিলেন আমার উপর। কয়েকদিন আগে শুনলাম, তাঁর নামে একটা লাইব্রেরী পাহাড়ে হচ্ছে। এ যে জেঁকে বসাটা, আমাদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেবার ব্যাপারটা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে আমাদের। অথচ কত ভালো ও জ্ঞানী ব্যক্তি পার্বত্য অঞ্চলে আছেন/ছিলেন, যাঁদের নামে কতকিছুর প্রতিষ্ঠান ও সড়কের নামকরণ হওয়া দরকার। কয়েকদিন পাহাড়ে ঘুরে, ক’টা টাকা দিয়ে, পাহাড়কে নিয়ে ক’টা লাইন লিখে পাহাড়ীদের মনে প্রতিষ্ঠিত হবার চেষ্টা, খুবই সন্দেহজনক।
একইভাবে হোসেন সোহেলও পাহাড়প্রেমী সাজতে ব্যস্ত। ভিডিও ভ্লগ বানিয়ে ঘুরেন। ভিউ বাড়ান। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে কীভাবে ভ্লগিং করতে হয়, সেটাতে কোর্স করিয়ে যাচ্ছেন। মানে তিনি আমাদের নিয়ে চিন্তায় তাঁর ঘুম হচ্ছে না, আমাদের পাহাড়ী যুবকদের ভিডিও ভ্লগ করিয়ে টাকা ইনকাম করিয়েই ছাড়বেন। এভাবে তিনিও আমাদের মননে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৌড়ে আছেন। পাহাড়ে যে অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণ হচ্ছে, সেটা তাঁর মাথাব্যথা না। তাঁর মাথাব্যথা কেন ভ্লগিং করে টাকা কামাচ্ছে না পাহাড়ীরা! যতদূর জেনেছি, তিনি কোন পেশায় জড়িত নয়। বরং পাহাড়কে ভ্লগিং করে তাঁর আয় হয়, এটাতে তাঁর চলে। যদি এটি সত্যি হয়, তাহলে সেটি খুবই দুঃখজনক। পাহাড় যে তাঁর ইনকামের একটা মাধ্যম, এটা আমরা ভুলে যাই।
আমাদের পার্বত্য অঞ্চলকে খুব ভালো করে বুঝেছিলেন দুজন বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক । একজন আহমদ ছফা এবং আরেকজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আহমদ ছফার নিবন্ধ সংকলন ‘শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত নিবন্ধ’ ও রাডারের বৈ-সা-বি সংস্করণে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাক্ষাতকার থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে নিয়ে তাঁদের মনোভাব জানা যায়। এ দুজন ছাড়া তেমন কোন লেখক ও সাহিত্যিককে পাইনি যারা পার্বত্য অঞ্চলকে ভালো করে জেনেছে। তাঁরা দুজন যেভাবে আমাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন, আমাদেরকে বুঝেছিলেন, এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম এ দুজনের কাছে কৃতজ্ঞ।
………………………………..
আজকে দেখলাম, বান্দরবানে কলা গাছের তন্তু থেকে শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এটি যুগান্তকারী আবিস্কার ও পরিবেশ বান্ধবও। এটি দেশের জন্য খুশীর খবরও। অনেকে এ নিউজ শেয়ার করেছে। অনেকের মতো আমারও এ নিউজ দেখে খুশী হবার কথা ছিল। কিন্তু আমি সবচেয়ে খুশী হতাম, যদি কলা গাছের তন্তু দিয়ে থুবুইং (থামি), পিনন, হাদি, পুছু (চাদর) তৈরির খবর দেখতাম। আমাদের বান্দরবানের কলাগাছ দিয়ে আবিস্কার, সেটা দিয়ে থুবুইং, পিনন-হাদি হবার বদলে শাড়ি হচ্ছে, এটা আমাকে খুব বেশি আনন্দ দেয় না।
একইভাবে কাপ্তাই বাঁধের বিষয়টিও আমরা জানি। আমাদের এলাকায় বাঁধ দিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে আলোকিত করা হচ্ছে। কিন্তু রাঙ্গামাটির বিভিন্ন এলাকায় এখনও বিদ্যুতের আলো নাই। একইভাবে সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে হলেও খাগড়াছড়ির প্রায় ৯০% পরিবার এ গ্যাস পাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ গ্যাস যাচ্ছে।
শত মন খারাপ খবরের ভিড়ে সুরকৃষ্ণ চাকমা থাইল্যান্ডের জাতীয় দলকে নকআউট করে দিয়েছেন, এটি আশাব্যঞ্জক। একে একে নকআউট করা পালা আসুক আমাদের, সেটা হোক অপরাজনীতি কিংবা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন-এসিমিলেশন!
0 Comments