মারমা জনগোষ্ঠী প্রায় ৭০০ বছর ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ—পূর্ব অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে। একটা জাতির পরিচিতি হিসেবে যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো দরকার তার প্রায় সবগুলো মারমা জাতির মধ্যে আছে। মারমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্য, ধ্যান—ধারণা ও প্রথা অনুসারে বংশ পরম্পরায় সুশৃঙ্খলভাবে বাস করার রীতিসমূহ সমৃদ্ধ। কিন্তু সেগুলোর তুলনায় মারমাদের নিজস্ব ইতিহাস এখনও অনাবিস্কৃত। এ ইতিহাস অনাবিস্কৃত হয়ে থাকার পেছনে অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ হল— মারমারা আধিপত্যবাদী জাতি নয়। প্রতিনিয়ত শোষিত ও নিগৃহীত হওয়া, উপনিবেশের শিকার হয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে অন্য জাতিতে একীভূত হওয়া, রাজনৈতিক কারণে এবং জীবিকার তাগিদে নতুন নতুন আবাসস্থল খুঁজে দেশান্তরী হওয়া জাতির ইতিহাস স্বাভাবিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার কথা না। ভারতীয় সামাজিক ইতিহাসবিদ রনজিৎ গুহের সাবঅল্টার্ন টার্মের সংজ্ঞা অনুসারে বললে, মারমা জাতির ইতিহাস একটি ‘সাবঅল্টার্নের ইতিহাস’ অথার্ৎ ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’। সাবঅল্টার্নদের ইতিহাস হবার কারণে ইতিহাসে জয়ীদের জয়জয়কারের ভীড়ে মারমা ইতিহাস রচনা করা খুবই দূরুহ ব্যাপার।
এ ধরণের দূরূহ বিষয়টিকে রচনা করে খুব সহজ ও সাবলিল ভাষায় মারমাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার চেষ্টা করেছেন মারমা সমাজে দুইজন সম্মানিত ও বরেণ্য ব্যক্তি। এ লেখকদ্বয়ের মধ্যে একজন হলেন— প্রাক্তন প্রফেসর মংসানু চৌধুরী এবং আরেকজন প্রধানমন্ত্রী কাযার্লয়ের সাবেক মহাপরিচালক উ ক্য জেন। তাঁদের এ গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের শেষের দিকে। ২০১৮ সালে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর পর এ গবেষণা কর্মটি শেষ হয়। খাগড়াছড়ি জেলার মারমা জনগোষ্ঠীর অন্যতম সামাজিক সংগঠন ‘মারমা উন্নয়ন সংসদ’ (মাউস) ‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ নামে ২০১৮ সালে বইটি প্রকাশ করে। পরের বছর অথার্ৎ ২০১৯ সালে এ বইয়ের ২য় সংস্করণ বের হয়। এ বইয়ে দুটি অংশে মোট তেরটি অধ্যায় আছে। প্রথম ছয়টি অধ্যায়ে মারমা ইতিহাস এবং বাকি সাতটি অধ্যায়ে মারমা লোক—সাহিত্য ও লোক—সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ বইটি অত্যন্ত তথ্যবহুল একটি বই। লেখকদ্বয় এ বইটিতে ২০০ এর অধিক রেফারেন্স ও অনেক ফুটনোট দিয়ে লিখেছেন। আমি এখানে ক্ষুদ্র পরিসরে ‘মারমা ইতিহাস’ অংশটি নিয়ে পর্যালোচনা করেছি।
প্রথম অধ্যায়ে লেখকদ্বয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ—প্রকৃতি, অধিবাসী ও ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেছেন। সেই সাথে মারমা জাতির ইতিহাস রচনার জন্য যে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো রয়েছে, সেগুলো বিস্তারিত বলেছেন। মারমা জাতি সম্পর্কিত প্রামাণ্য দলিলের অভাব, আরাকানের বিভিন্ন ইতিহাস বিভিন্ন কিংবদন্তি মিশ্রিত ও সেগুলো প্রায় ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে যোগ থাকায়, বিভিন্ন জাতির ভাষায় মারমা জাতিকে নিয়ে গবেষণাকর্ম হওয়ায় এবং বিভিন্ন আধিপত্যবাদী জাতিগোষ্ঠী বর্ণবাদ ও বিভাজনের দৃষ্টিকোণ থেকে সভ্য ও অসভ্য মানুষের মধ্যে তুলনা করে এবং সংখ্যাগুরু—সংখ্যালঘু ভিত্তিক বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে মারমা জাতিকে নিয়ে লিখিত হওয়ায় মারমা জাতির ইতিহাস রচনায় এগুলোকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এখানে লেখকদ্বয় উল্লেখ করেছেন, যে প্রতিন্ধকতাগুলো অতিক্রম করতে পরবতীর্ প্রজন্মের মারমা গবেষকদের সহযোগিতা করবে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে টিবেটো—বার্মান ও অস্ট্রো—এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখকদ্বয় এ অধ্যায়ের শুরুতে বলেছেন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ও উত্তর—পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যের মারমাভাষী জনগোষ্ঠীরা জাতিগতভাবে মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীভূক্ত এবং ভাষাগত বিচারে টিবেটো—বার্মাণ ভাষা পরিবারের প্রভাবশালী শাখা ‘বমা’/‘বার্মান’ বা ‘বমী’ ভাষার অন্যতম উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা আরাকানী ভাষায় কথা বলে। এ টিবেটো—বার্মান ভাষা পরিবারের সদস্যরা দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর ও পূবার্ংশ যেমন— নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, উত্তর ভারতের সিকিম, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এছাড়াও দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ার বামার্ বা মায়ানমারে এ ভাষার প্রধান্য রয়েছে। ইতিহাসবিদ ও নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন, টিবেটো—বামার্ন ভাষা পরিবারের অন্তর্গত একটি বড় সংখ্যক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রায় সহস্রাধিক বছর হতে তিব্বতের উত্তর—পূবার্ঞ্চল ও চীনের দক্ষিণ—পশ্চিম ইউনান প্রদেশ থেকে তিনটির বেশি পথ ব্যবহার করে বামার্য় অভিবাসন শুরু হয়। প্রথম দল আসে মোয়ে—খেমের দল। এ দলটি চীনের উচ্চ মালভূমি থেকে এসে মেকং নদীর উজানে পৌঁছে। এরপর মেকং নদীর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রাক্কালে ‘খেমের’ দলটি কম্বোডিয়ায় ঢুকে পড়ে এবং ‘মোয়ে’ দলটি আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে থাইল্যান্ডে ঢুকে পড়ে। তারপর তারা সম্ভবত/আনুমানিক ২৫০০—১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বামার্র নিম্নাঞ্চল ইরাবতী, সালউয়েন ও সিতং নদী অববাহিকায় এসে পৌঁছায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে থাটন বন্দরের কাছে ‘সুবর্ণভূমি বা সুবন্নভূমি’ নামে ‘মোয়ে’রা তাদের প্রথম রাজ্য স্থাপন করে। সুবর্ণভূমি বা সুবন্নভূমির অপর নাম রামাঞ্যাদেসা (Ramannadesa)। এ রামাঞ্যাদেসা মূলত তখনকার নিম্ন বামার্র পাথাইন (Pathien), মুত্তামা (Muttama) ও হাইন্সাওয়াদি (Hanthawaddy) এর সম্মিলিত নাম। এ ‘মোয়ে’দের দ্বারাই পরবতীর্তে জলোধান প্রবর্তিত হল, বর্ণমালা আসল, বৌদ্ধধর্ম আরও সুপরিচিত হল এবং বর্তমান বামার্র সাহিত্য, কলা ও সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটল।
তারপর টিবেটো—বামার্ন পরিবারভূক্ত ‘প্যু’ জাতিগোষ্ঠীদের আরেকটি দল খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের মধ্যে আপার ও মধ্য বামার্র ইরাবতী, ছ্যেংদোয়েন ও সিতং নদীর সঙ্গমস্থলে সমতল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একাধিক ‘নগর রাষ্ট্র’ গড়ে তুলেছিল। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে ‘তারা হালেং’ নামে প্রথম নগর রাষ্ট্র গড়ে ওঠেছিল। বৌদ্ধ পঞ্জিকার অনুকরণে প্যু’দের তৈরী ‘প্যু’ পঞ্জিকা পরবতীর্তে ‘বমীর্ পঞ্জিকা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ৯ম শতকের মধ্যে আপার বামার্য় এবং লোয়ার বার্মায় যথাক্রমে প্যু ও মোয়েদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছিল।
সর্বশেষ যে দলটি ৯ম শতকে চীনের ‘নানঝাও’ রাজ্য থেকে তিব্বত হয়ে বামার্র ইরাবতী নদীর উজানে প্রবেশ করে, সেই দলটি হল টিবেটো—বামার্ন পরিবারভূক্ত ‘বামার্ন’ বা ‘ব্মা’ নামের একটি জাতিগোষ্ঠীদের দল। প্রথমে এ দলটি প্যু’দের মুখোমুখি হয়। বামার্নস বা বমাদের দুর্ধর্ষ অগ্রাভিজানের সামনে প্যু’রা দাঁড়াতেই পারেনি। তারা সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়। এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত নগর রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়ে। আনুমানিক ৮৪৯ সালের দিকে বার্মান বা বমা’রা প্যু’দের উৎখাত করে ‘বাগাইন’ (Pagan) নামে নগর গড়ে তুলে। ১৩শ শতকের মধ্যে প্যু’রা নিজেদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে বামার্ন বা বমা জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। বাগাইন রাজ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজ্য আকার বাড়তে থাকে। প্রথমে বামার্নরাজ আনারাত্থা ১০৫৭ সালে ‘মোয়ে’ রাজ্য ‘সুবর্ণভূমি বা সুবন্নভূমি’ আক্রমণ করে বাগাইন রাজ্য অন্তর্ভূক্ত করে নিলেন। এতে বামার্নদের বিভিন্ন কলাকৌশল শেখানোর জন্য ‘সুবর্ণভূমি বা সুবন্নভূমি’ থেকে ভিক্ষু, কারুশিল্পী, কারিগর, স্থপতি, পন্ডিত, স্বর্ণকারদের নিয়ে আসা হল। অবশ্য ১২৮৭ সালে ‘মোয়ে’রা তাদের হারানো রাজ্য পুনঃরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবতীর্তে ১৫৩১ সালে তংগু রাজ্যের বামার্নরাজ (বর্মীরাজ) থাবিংশোয়েথী মোয়ে’দের রাজ্যে আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে মোয়ে’রা পরাস্ত হয়।
তার প্রায় দেড়শো বছর পর মোয়ে’রা নিজেদের রাজ্য হাইন্সাওয়াদিতে সংঘটিত হলে শুরু করলে আবার ১৭৫৭ সালে বমীর্রাজ আলংফারা (Alaungphaya) চূড়ান্তভাবে ‘মোয়ে’ রাজ্য হাইন্সাওয়াদি অধিকার করে নেন। ১০৫৭ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত মোয়ে ও বামার্নদের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে বামার্নরাই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়েছিল। প্যু’দের মতো ‘মোয়ে’রা বামার্নদের সাথে একীভূত হয়ে যায়। শুধু ‘প্যু’ ও ‘মোয়ো’রা নয়, বামার্নদের আগ্রাসী অভিযানের ফলশ্রম্নতিতে ‘থেট’ ও ‘কানরান’রাও বামার্নদের সাথে একীভূত হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, ‘বার্মান’দের সাথে ‘মোয়ে’, ‘প্যু’, ‘থেট’, ‘কানরান’রা একীভূত হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তারা সম্মিলিতভাবে ‘ম্রাইনমা বা ‘ম্রাইন্মা’ নামে পরিচিত হতে শুরু করে।
‘মারমা’ শব্দটির উৎপত্তি প্রসঙ্গে লেখকদ্বয় বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের লেখার রেফারেন্স দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, ‘ব্রাহ্মা’ থেকে ‘ব্রাইহ্মা’ এবং ‘ব্রাইহ্মা’ থেকে বিবর্তিত হয়ে ‘ম্রাইনমা’/‘ম্যাইন্মা’/‘মারমা’ বা ‘মারামা’ অভিধার উৎপত্তি হয়েছে। এছাড়াও ‘প্যু’, ‘থেট’, ‘কানরান’ ‘মোয়ে’ ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর মিশ্রণ থেকে এ ‘ব্রাহ্মা’ বা ‘ব্রাইহ্মা’ জাতির সৃষ্টি হয়েছে বলে বামার্র ইতিহাসে লিখিত আছে।
‘মারমা জাতিঃ শিকড়ের সন্ধান’ এর অংশে মারমাদের আদিপুরুষের সম্পর্কে কয়েকটা যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছে। যেমন— মারমা’রা [ক] আরাকানী বংশোদ্ভূত, [খ] বমীর্ কূলদ্ভূত অথবা [গ] মোয়ে/তলইং বংশোদ্ভূত। ‘মারমা’রা আরাকানী বংশোদ্ভূত— এ ধারণা অনুযায়ী, ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রামে কর্তৃত্বকারী আরাকানীরা চট্টগ্রাম বন্দর মোগলদের কাছে হাতছাড়া হয়ে গেলে আরাকানীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে পশ্চাদপসরণ করে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। আবার অনেকেই বলেন, ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বামার্ আরাকান দখল করার পর বাঙলা/পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে আসে। আরেকটা সূত্রমতে, বর্মীরা নিজেদেরকে আরাকানীদের বংশধর মনে করে থাকে এবং বমীর্রা আরাকানীদের ‘মারমাগ্রী’ অথার্ৎ জ্যেষ্ঠ বমীর্ নামে অভিহিত করত। আবার হ্যামিল্টনের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকেরা আরাকান/রাখাইন দেশ থেকে এসেছে এবং তারা নিজেদেরকে ‘মারামা’ নামে অভিহিত করে থাকে। এছাড়াও সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার ক্য মিন তিন ‘মারমা, মারামা ও রাখাইন’রা আসলে একই জাতি, এমনটি দাবি করেছেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ড ও অন্যান্য সূত্র বলছে, মারমা’রা দুই পযার্য়ে আরাকান থেকে চট্টগ্রামে এসেছিল। প্রথম পর্যায়ে ১৪শ থেকে ১৭শ শতাব্দীতে অভিবাসন হয়েছিল যখন 'ম্রকউ' রাজ্যের উত্থানকালে আরাকানী রাজ্য ঢাকার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তখনকার অভিবাসন ঘটেছিল স্বাভাবিক নিয়মে। মূলত জীবিকার তাগিদে বা ভাগ্যের অন্বেষণে। দ্বিতীয় পযার্য়ে অভিবাসন হয়েছিল বমীর্রাজ ‘বোদোফেয়া’ (Bodawpaya) ১৭৮৪ সালে অভিযানকালে। তখন তিনি আরাকান দখল করলে বমীর্র সেনার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে আরাকানীরা দলে দলে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।
আরেকটা সূত্র বলছে, মারমা’রা আরাকানী নয়। বরং 'ম্রাইনমা' বংশোদ্ভূত। কারণ বামার্নদের সাথে প্যু, মোয়ে, থেট ও কানরান’দের মিশ্রণে ‘ম্রাইনমা’ নামটি পরিচিতি লাভ করে। আবার উইকিপিডিয়া সাইটেও মারমা’দেরকে বমীর্ বংশোদ্ভূত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এছাড়াও জে পি মিলস্ও মনে করেন, মগরা (মারমা) বমীর্। সর্বশেষ যে সূত্রটি হল— মারমা’রা তলইং/মোয়ে বংশোদ্ভুত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৯৯ সালে আরাকানের রাজ ‘মাংরাজাগ্রী’র সেনাধিপতি ‘মাহাপাঞ্যাগ্রী’ হাইন্সাওয়াদির রাজধানী ‘বোগো’ (Pegu) আক্রমণ করে ধ্বংস করে দিয়ে সেই রাজ্যের দুই রাজকুমার যথাক্রমে ‘মঙ চ প্যাইন ও অং জিয়া’ ও এক রাজকুমারী ‘সাইন্দা হ্নং’ সহ ৩৩ হাজার তলইং যুদ্ধবন্দী ও অন্যান্য লুন্ঠিত সামগ্রী আরাকানে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, হাইন্সাওয়াদি রাজ্যের রাজধানী বোগো শহরের অধিবাসী ‘মোয়ে’রা আবার ‘তলইং’ নামে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ ‘মোয়ে’ মানেই ‘তলইং’। ‘বোগো’ থেকে নিয়ে আসা ৩৩ হাজার যুদ্ধবন্দীদের আরাকান রাজা কালাদাইন এর উজানে নদীর উপত্যকা অঞ্চলে পুনবার্সিত করেন। রাজা ‘বোগো’ রাজ্যের রাজকুমারীকে বিয়ে করেন এবং তাঁর নিজ কন্যার সাথে ‘মঙ চ প্যাইন’কে বিয়ে দিয়ে দেন। ১৬১৪ সালে আরাকান রাজা তার জামাতা ‘মঙ চ প্যাইন’কে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও বাকেরগঞ্জের শাসনকাজ পরিচালনার জন্য চট্টগ্রামের ভাইসরয় হিসেবে নিয়োগ দেন। এ সময়ে কালাদাইন নদীর উপত্যকায় যে সব তলইং যুদ্ধবন্দীদের পুনবার্সিত করা হয়েছিল, তাদের মধ্য হতে ২ হাজার জনকে ‘মঙ চ প্যাইন’ এর সাথে পাঠানো হয়েছিল। মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কৃতিত্বস্বরুপ ১৬২০ সালে আরাকান ‘রাজ মঙ চ প্যাইন’কে ‘বোমাং’ অথার্ৎ সেনাপতিদের কর্ণধার’ উপাধিতে ভূষিত করেন। উল্লেখ্য যে, বর্তমান বোমাং রাজ পরিবারের ধারাবাহিক বংশতালিকায় তিনিই প্রথম বোমাং রাজা। এক সময় বোমাংদের ভাগ্যে বিপর্যয় হতে শুরু করে। চট্টগ্রাম মোগলদের কাছে হাতছাড়া হয়ে গেলে পরবতীর্তে বোমাং সাঙ্গু নদীর দক্ষিণাংশে অথার্ৎ চট্টগ্রাম অংশে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেন। এরপর রামু, লামা, সুয়ালক ঘুরে ঘুরে ‘রাআ—দ’—তে (বর্তমান বান্দরবান) স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেন।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ‘মারমা—মগ বিতর্ক’ অংশে ‘মগ’ শব্দের উৎস ব্যাখ্যায় লেখকদ্বয় অনেকগুলো তত্ত্ব ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ‘মগ’ অভিধাটি ‘বহিরারোপিত’ (exonym) অথার্ৎ বিদেশীদের দ্বারা আরোপিত একটা নাম। কোনভাবেই স্বজাতি—আরোপিত (ethnonym) নয় অথার্ৎ যে জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে ‘মগ’ শব্দের ব্যবহার হচ্ছে সেটা কোনভাবেই ঐ জনগোষ্ঠী কর্তৃক প্রদত্ত কোন নাম নয় এবং তাদের শব্দভান্ডারে এ জাতীয় কোন শব্দ নেই।
‘মারমাদের ‘পূর্বপুরুষ’ কারা?’ এ অংশে লেখকদ্বয় মারমাদের পূর্বপুরুষ কারা সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য তারা বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞদের অভিমতকে বিবেচনায় নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। বামার্নদের সমর্থনে কয়েকটি মত বলছে, মারমা’রা কয়েক শতাব্দী পূর্বে মধ্য বামার্ থেকে আরাকানে এসে পরবতীর্তে তারা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। পরে তারা পার্বত্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে শেষে সবকিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে লেখকদ্বয় প্রধানত দুটি প্রমাণের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, মারমা’রা তলইংদের উত্তরসূরী। প্রথমটি হল— বাংলাদেশের অধিকাংশ মারমা’রা মনে করে যে, মারমা’রা তলইং’দের উত্তরসূরী। দ্বিতীয়টি হল, খ্যংসা (বর্তমান মারমা) ও তলইং কোন আলাদা জাতি নয়। তাই লেখকদ্বয়ের দাবি, মারমা’রা পুরোপুরি টিবেটো—বার্মান প্রভাবিত অস্ট্রো এশিয়াটিক শাখার জনগোষ্ঠী ‘তলইং’।
*এ লেখাটি বিএমএসসি চবি শাখার নিয়মিত বার্ষিক ম্যাগাজিন “পাইং অমুঙ” এ প্রকাশিত
0 Comments