সম্প্রতি স্থানীয় এক নিউজ মিডিয়ায় 'মারমাদের বিবাহ সনদ' এর বিষয়ে একটা ভিডিও দেখছিলাম। মূলত সেটি মারমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিডিও যেখানে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, হেডম্যানসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এবং সেখানে বাংলায় লেখা একটি কাগজ (সম্ভবত সনদ) নববিবাহিত দম্পতির হাতে তুলে দিয়ে ছবি তুলতে দেখা গেছে উনাদের। এর ফলে মারমা সমাজে নতুন করে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তারপরের ওই নিউজ মিডিয়ার পরবর্তী ভিডিওতে 'মারমা বিয়ে সনদ' নিয়ে বিশিষ্টজনের বক্তব্য শিরোনামে যে কয়েকজনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে, সেখানে দেখা গেল 'বান্দরবান হেডম্যান কারবারি কণ্যাণ পরিষদের সভাপতি হ্লা থোয়াই হ্রী, চাকমা রাজা ও খাগড়াছড়ি প্রাক্তন চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী- এ তিনজনের বক্তব্য আছে। সেই ভিডিওতে বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে হ্লা থোয়াই হ্রী এর বক্তব্য। বাকি দুজনের বক্তব্য খুবই কম।
প্রথমে প্রথা প্রসঙ্গে আসা যাক। একটা জনগোষ্ঠী বা জাতি দীর্ঘকাল ধরে কতগুলো নিয়ম বা রীতি-নীতি পালন করে থাকে। সেগুলো পরবর্তীকালে প্রথারুপে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সমাজ স্বীকৃত। প্রথাকে শুধুমাত্র আইন বা প্রথাগত আইনের দৃষ্টিতে দেখলে বা বিবেচনা করলে সেটি ভুল হয়ে যাবে। আইডেন্টিটির দৃষ্টিতে প্রথা একটি জাতির আইডেন্টিটির অংশ। একটা জাতির কতগুলো আইডেন্টিটির বৈশিষ্ট্য আছে, তার মধ্যে প্রথা একটি। আর পলিটিক্যাল বা অধিকারের দৃষ্টিতে হলে প্রথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বা স্বশাসনের একটা অংশ যা অন্য কেউ এমনকি রাষ্ট্রেরও কোন প্রভাব নাই। বরং প্রথাগত আইনকে রাষ্ট্রকেই স্বয়ং স্বীকৃতি দিতে হয়।
প্রথা সবচেয়ে আপডেটেড ও যুগোপযোগী একটা রীতিনীতি বা আইন। সমাজ যখনই মনে করে যে, এ রীতি-নীতি যুগের সাথে চলনসই নয়, তখনই সেটি বাতিল হয়ে যায় বা সেই প্রথায় সংশোধন আনা হয়। যেমন, আগেকার যুগে বিয়ের সময়ে সমাজের সবার অংশগ্রহণে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। তারপর বিভিন্ন রীতি-নীতি পালন করার পরে বিয়ের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হয়। কিন্তু গত ১০-২০ বছরে নতুন একটি রীতি যুক্ত হয়েছে আমাদের সমাজে, সেটি হল- বিয়ের অনুষ্ঠানে দুই পক্ষ উপস্থিত হয়ে বা না হয়ে একটি আর্থিক অংক ধার্য্য করে এ বলে যে, যদি বর কনেকে ছাড়ে বা ছাড়তে চায়, তাহলে বর থেকে কনেকে একটা নির্দিষ্ট অংকের (২/৫ লাখ) টাকা দিতে হবে। কনে ছেড়ে গেলেও একই পরিমাণ টাকা দিতে হবে। এটি করার কারণ মূলত বিবাহকে দৃঢ় করার জন্য যাতে কোন ক্ষুদ্র কারণে বা ছুতোয় যাতে কেউ কাউকে ছেড়ে না যায়। এটি করার কারণ হচ্ছে, সমাজ কয়েক বছর পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে যে, এ জিনিসটি করা হলে তাদের বিচ্ছেদ কমে যেতে পারে, তাই এসব করেছে। এটি যুগের সাথে মিলে আপডেট হয়েছে। আগে এমন প্রথা নাই কিন্তু সমাজ চায় এবার, তাই এবার থেকে হচ্ছে। এ রীতিটা সব জায়গায় পালন করা হয় না, সব সমাজে এখন প্রতিষ্ঠিতও নয়। সব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত না হলেও এটি প্রথারুপে এখন প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে। সুতরাং প্রথা সব জায়গায় একই নয়, প্রথা জায়গাভেদে ভিন্নভাবে পালন করা হয়।
যেমন পার্বত্য অঞ্চলের কোন এক জায়গায় (সঙ্গত কারণে জায়গার নাম বলছি না) 'মুছমা ম্রিং' (বাংলায় করলে হতে পারে বিধবা ঋণ) আছে। আর অন্য জায়গায় নাই। যদি কোন নারী বিধবা হয়, তাহলে সে স্বামী ছাড়া বসবাস করার জন্য পাড়া-পড়শীদের থেকে ধার নিয়ে থাকতে পারে। ঋণ নিয়ে থাকতে পারে। যখন সেই বিধবাকে কোন ছেলে বিয়ে করতে চায়, তাহলে ওই বিধবার যাবতীয় ঋণ শোধ করেই বিধবাকে বিয়ে করতে হয়। এটি সব জায়গায় নেই বা আগে ছিল এখন নেই। যৌক্তিক কারণে হয়তো এখন, এ সময়ে সেই প্রথা অন্য জায়গায় নাই। কিন্তু এখনও ওই জায়গায় আছে। তাই প্রথা জায়গাভেদে ভিন্ন হয়।
বিয়ে সনদের পক্ষে অনেকে হয়তো বলে থাকবেন যে, সনদের মাধ্যমে বিয়েটাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ দলিলের মাধ্যমে সামাজিক স্বীকৃতি। তার মানে কি এর আগে বিয়েগুলো সমাজ স্বীকৃত নয়? যখন কোন মেয়ে বিয়ে করার জন্য অন্য কোন ছেলের সাথে পালিয়ে যায় এবং পরে যখন বরকে সঙ্গে করে গ্রামে নিয়ে আসে, তখন যুব-যুবতীদেরকে একটা নির্দিষ্ট অংকে অর্থ দিতে হয়। ওই মেয়েটি গ্রামে থাকার সময়ে দেখভাল করেছিল এবং ভবিষ্যতেও তাদের দাম্পত্য সম্পর্কে সমস্যা হলে সাহায্য করে যাবে। একই সাথে এটি যুবক-যুবতীদের মাধ্যমে অঘোষিত ও অলিখিত স্বীকৃতি। তারপর গ্রাম প্রধান কার্বারীকে 'পোয়েরা মাংগে' (পান,সুপারী,মিষ্টান্ন ও পিঠাপুলি) দিতে হয়। অর্থাৎ কার্বারীর মাধ্যমে গ্রামবাসীকে জানানো হয় যে, তারা বিয়ে করেছে। এ 'পোয়েরা মাংগে' কার্বারীকে দেবার সাথে সাথে কার্বারী তথা গ্রাম থেকে তাদেরকে অলিখিত ও অঘোষিত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে ধরা হয়। এবার থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সংসার করতে পারবে। এ 'পোয়েরা মাংগে' প্রথাটি এখনও প্রায় সব জায়গায় আছে। পোয়েরা মাংগে না দিলে বিয়েটাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বলে ধরা হয় এবং যেহেতু বিয়ে হয় নাই বলে ধরা হয়, সেহেতু তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের সমস্যা হলেও কার্বারী বা গ্রামবাসীরা যাবে না। এ পোয়েরা মাংগে দেবার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বরকে চেনা। কোথাকার কোন ছেলের সাথে গ্রামে মেয়ে পালিয়ে গেল, সেটা তো কার্বারীসহ গ্রামবাসীকে জানতে হয়।
একটা ঘটনা দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। কোন এক গ্রাম থেকে একটি মেয়ে এক ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বসবাস করে। তাদের দুই-তিনটি সন্তান আছে। পিতার সম্পত্তি বন্টনের সময় ছোট মিমাংসা বা সালিশ বসলে সেই মেয়েটি গ্রামে আসে। তখন কার্বারী-হেডম্যানসহ সবাই ওই মেয়েটি সম্পত্তি দিতে অস্বীকৃতি জানায় যতক্ষণ না সে তার স্বামীকে নিয়ে গ্রামে আসে এবং কার্বারীকে 'পোয়েরা মাংগে' দেয়। অর্থাৎ কার্বারীকে পোয়েরা মাংগে দেবার পরে সে তার বাবার সম্পত্তি পাবে।
মারমাদের যাবতীয় রীতিনীতি, প্রথাগুলো অলিখিত। কোডিফাই অর্থাৎ লিখিত না হবার সুবিধা অনেক। কোডিফাই না হলে প্রথা সমাজের ও যুগের চাহিদা অনুসারে সমাজমুখী করে পরিবর্তন করা যায়। সময়ের সাথে যে প্রথাগুলো যুগোপযোগী নয়, সেগুলো আমরা ইতিমধ্যে বাদ দিয়েছি। আর যেগুলোর এখনও প্রাসঙ্গিকতা আছে, সেগুলো এখনও বিরাজমান। আগেকার যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। জনসংখ্যা কম হওয়ায় এক গ্রাম থেকে এক গ্রাম দূরে। গ্রামে নিজেদের মধ্যে বিয়েটা হয়। প্রেম হয়। ফলে অনেকেই আত্মীয় স্বজনকে বিয়ে করে ফেলে যেগুলো অনেকসময় নিষিদ্ধ নিয়ম। যেমন মামা-ভাগ্নে বিয়ে করা যায় না। যদি বিয়ে করে ফেলে তাহলে তাদেরকে পশুর সাথে তুলনা করা হয়। একটা ফলের পুরোপুরি পঁচেছে বলে ধরা হয়। তাই আলাদা শুকরের খোঁয়াড় তৈরি করে দুইজনকেই সেই দুটি আলাদা খোঁয়াড়ে ঢুকানো হয়। তারপর তাঁদের শুকরের খাবার খেতে দেওয়া হয়। তাদেরকে সেগুলো খাওয়ার অভিনয় করতে হয়। এরপর বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি শেষে সেখান থেকে বের করা হয় এবং তারা পুনর্জন্ম নিয়েছে হিসেবে ভাবা হয়। এখন আর এ ধরণের বিয়ে কম। যোগাযোগ বাড়ছে। লামা থেকেও খাগড়াছড়িতে বউ আনা যায়। ফলে মামা-ভাগ্নের মধ্যে বিয়েটা কমে যাচ্ছে। শুকরের খোঁয়াড়ে ঢুকানোর প্রথাটা একেবারেই নাই হয়ে গেছে। আর যদি সেরকম নিষিদ্ধ বিয়ে করেও ফেলে, তাহলে এখন আর যুগকে বিবেচনা নিয়ে খোঁয়াড়ে ঢুকানো হয় না, কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে বিচ্ছেদ করা হয়। কোডিফাই না হওয়ার সুবিধা এটি। যখনই মনে হবে সমাজের কাছে যে, এ এ প্রথাগুলো যুগোপযোগী নয়, তখনই পরিবর্তন করা যাবে, সংশোধন করা হবে। কিন্তু কোডিফাইকৃত নিয়ম বা আইনগুলো ইচ্ছে করলে পরিবর্তন করা যাবে এবং এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
যেমন, ১৯০০ সালে রেগুলেশনে বলা আছে, প্রথম শ্রেণী জমির একর প্রতি খাজনা ৩ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর জমি ২ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণীর জমি ১ টাকা। ১৯০০ সালের আইন ২০২৩ সালে এসেও সেই ৩ টাকা,২ টাকা, ১ টাকা নিতে হচ্ছে একর প্রতি। কারণ এর মধ্যে সেই আইনের কোন সংশোধনী হয় নাই। ১৯০০ সালের বাস্তবতা ও টাকার মান নিশ্চয় ২০২৩ সালের সাথে মিলবে না। কিন্তু সেই আইনটি এখনও রয়ে গেছে, যা কোডিফাই আইনের ব্যর্থতাকে নির্দেশ করে।
সাক্ষাৎকারের ওই ভিডিও ধরে বলি এবার। ওই ভিডিও এর সাক্ষাৎকারে হ্লা থোয়াই হ্রী ও কংজরী বলেছেন, বিদেশে যারা যাচ্ছে, তাদের জন্য সুবিধা হচ্ছে। শুধুমাত্র বিদেশগামীদের কথা মাথায় রেখে যদি এ সনদ চালু করা হয়, তাহলে 'কয়েকজনের' জন্য পুরো জনগোষ্ঠীর উপর চালু করা হচ্ছে, যা যৌক্তিক নয়। বিদেশগামী মারমা সমাজে ছোট্ট অংশ মাত্র (হীন অর্থে নয়)। এ ছোট্ট অংশের কথা মাথায় রেখে বাকি বিশাল অংশ, যারা বিদেশ যাচ্ছে না, তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আরেকটি প্রসঙ্গ উঠেছে, সেটি হল সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে নারীর পক্ষে এ সনদ কাজে লাগবে। এটি বোধগম্য নয় যে, কেন এ সনদটি সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে কাজে লাগবে! এরকম সনদ না থাকায় অর্থাৎ স্ত্রীর স্বীকৃতি নিয়ে সমস্যা হওয়ায় মারমা সমাজে কোন নারী সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এমন জানা নাই। আর এ সনদ থাকলেও (যদিওবা এখনও নারীকে ছেলের সমান সম্পত্তি দেওয়া হয় না) এবার থেকে নারীকে পিতার সম্পত্তির ভাগ দেওয়া হবে, এমন নিশ্চয়তা বা বিধান নাই। ফলে এটি বলা যাবে না যে, এ সনদ থাকলে নারী পিতার সম্পত্তির ভাগ পাবে।
ওই সাক্ষাৎকারে হ্লা থোয়াই হ্রী বলতে চেয়েছেন জন্ম নিবন্ধনের সাথে তুলনা করে, যা পুরোপুরি সামঞ্জস্য নয়। জন্ম নিবন্ধন একটা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিষয়। নিরাপত্তার বিষয়। পরিকল্পনা-বাজেট প্রণয়নের বিষয়। মানবসম্পদের বিষয়। এটির সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক গভীর। কিন্তু এ বিয়ে সনদের সাথে রাষ্ট্রের তেমন কোন সম্পর্ক নাই। এবং বিয়ে পুরোপুরি ব্যক্তিগত ও সামাজিক। একই সাথে সেখানে চাকমা রাজার সাক্ষাৎকার আছে, সেখানে তিনি বলেছেন, যারা বিদেশ যাচ্ছে, তারা তো ইতিমধ্যে সনদ নিয়েছেন। হেডম্যানও দিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে তিনিও দিয়েছেন। এবং এ সনদ বাধ্যতামূলক নয়। এটি থেকে বুঝা যায়, যাদের লাগে, তারা নেবে, অতীতে নিয়েছিল। ফলে এটিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে এবার থেকে বিয়ে সনদ লাগবে, এমন করে প্রচারণা করা হচ্ছে, যা কাম্য নয়। চাকমক রাজা এও বলেছেন, এটি বিয়ে সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত, ফলে এখানে হেডম্যান বা রাজার কোন এখতিয়ার নাই যে, সনদ নিতে হেডম্যান বা রাজা বাধ্য করবে। অর্থাৎ এটি পুরোপুরি সমাজের বিষয়, হেডম্যান বা রাজার কোন ভূমিকা থাকার কথা না।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একজন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, আরেকজন প্রাক্তন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (তিনি হেডম্যানও)সহ আরও কয়েকজন বিয়ে সনদ নবদম্পতির হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। এবং তখন থেকে এ সনদ দেওয়া চালু হয়েছে বলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ সনদ চালু হচ্ছে সেখানে তিন সার্কেলের তিন রাজা নাই, কোন জনমত যাচাই করা হয়নি- এমন অবস্থায় এ সনদ প্রচলন প্রথার বিরুদ্ধ। এমনকি এ ধরণের সনদ বিতরণ স্বয়ং রাজা বা হেডম্যান এককভাবে করতে পারেন না। সেখানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে (ভিডিওতে যেমন বলা হয়েছে) এ প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের বিষয়- বিয়ে সনদ- চালু অযৌক্তিক ও প্রথাবিরুদ্ধ। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কোনভাবেই মারমাদের প্রথাগত প্রতিষ্ঠান নয়। এটি রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথাগত বিষয়াদি দেখভালের জন্য প্রথাগত প্রতিষ্ঠান যেমন কার্বারী, হেডম্যান ও রাজা আছেন। ফলে রাষ্ট্রের স্বশাসিত একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে প্রথাগত বিষয়ের উপর হস্তক্ষেপ অযৌক্তিক ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবমাননাও বটে।
আইডেন্টিটির প্রসঙ্গে যদি বলি, তাহলে প্রথা হচ্ছে একটা জনগোষ্ঠীর (বিশেষ করে স্বল্প জনসংখ্যার) আইডেন্টিটির কতগুলো অংশের মধ্যে একটি। একটা জাতিকে চেনা যায় কী কী দিয়ে মূলত? তার খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ধর্ম, শারিরীক গঠন, রীতিনীতি, প্রথা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনাচার, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কেমন- এসব দিয়ে। ফলে এখান থেকে যদি একটি (যেমন অলিখিত প্রথা) হারিয়ে যায়, তাহলে এটি আমাদেন জন্য চরম আশঙ্কাজনক। হারিয়ে না গেলেও সেটি যদি মেইনস্ট্রিম জনসংখ্যার মতো লিখিত, কোডিফাইড হয়ে যায়, তাহলে আমাদের সাথে মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠীর আর পার্থক্য থাকল না। ফলে এসিমিলেশনের এক ধাপ এগিয়ে গেল।
পলিটিক্যাল দৃষ্টিতে যদি দেখি, তাহলে দেখব, মারমা'রা স্বশাসিত ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ভোগ করছে। নিজেদের গোষ্ঠী দ্বারা শাসিত। ফলে তাদের খুব কাছেই হয় এ প্রথাগুলো। এখানে বাইরের কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে শাসিত হয়েছে, এটা অকল্পনীয়। কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের স্বশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমাদের সবকিছুই নিজেদের সমাজ কর্তৃক আরোপিত ও স্বীকৃত। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুতেই সমাজের ভূমিকা আছে। ফলে রাষ্ট্র বা বাইরের অন্য কোন প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রাতিষ্ঠাকীকরণ তেমন হয়নি। আর দরকারও পড়েনি। কোন একটা বিষয় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়ে গেলে সেখানে সমস্যাটা হয়ে যায়।
অস্ট্রিয়ার দার্শনিক ইভান ইলিচের বিখ্যাত বই 'Deschooling Society' তে কীভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলো প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গেছে, সেগুলো বলা আছে। এছাড়াও কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোকে অপ্রাতিষ্ঠানিক (School কে Deschool, Establish কে Destabilise) করা গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোও বলা আছে। মেক্সিকোতে একটা জনগোষ্ঠীর আগেকার সময়ে জন্ম ও মৃত্যুর বিষয়গুলো ছিল স্বাভাবিক। জন্মের পরে হঠাৎ করে হাসপাতালে নেওয়া শুরু হল, যেটা আগে বাড়িতে ধাত্রীর হাতে হত। এখানে প্রতিষ্ঠান এসে দাঁড়িয়েছে হাসপাতাল। যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে, তারা হাসপাতালে যাচ্ছে। যাদের সেই সামর্থ্য নাই, তারা যেতে পারছে না। এখানে স্পষ্টত বৈষম্য দাঁড়িয়ে গেছে। একইসাথে মৃত্যুর পরবর্তী যাদের টাকা আছে, তারা জাঁকজমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করেছে, যাদের নাই, তারা করতে পারে না। অথচ আগেকার সময়ে মৃত্যু হলে সবার পরিণতি একই হত, হয় পুড়িয়ে ফেলত, নাহয় কবর দেওয়া হত। জন্ম ও মৃত্যুর মতো স্বাভাবিক বিষয়েও পরে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটলে বৈষম্য দাঁড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিক বিষয়কে ঘিরেও বৈষম্যের একটা রেখা হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রের জন্য যা যা গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোই শেখানো হয় শুধু। রাষ্ট্র চায় সেসব পড়ে রাষ্ট্রকে ফিডব্যাক দিক। ফলে স্বাভাবিকভাবে পাহাড়ী ছেলেমেয়েরা আইন পড়ে পাশ করে গিয়ে রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যে সারাজীবন কাটাবে, এটা স্বাভাবিক। এ আইনের বাইরেও আমাদের জীবনাচার যে প্রথাগত আইনের উপর নির্ভরশীল, সেসব খুব কমই দেখে। আমাদের অর্ডিন্যান্সে Indigen Laws নামে কোর্স ছিল কিন্তু কখনই পড়ানো হয়নি। ফলে বেশিরভাগ পড়ানো হয়েছে জাতীয় আইনের বিষয়ে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সফল। রাষ্ট্র যেভাবে চায়, যে আউটপুট চায়, সেই ধরণের আউটপুট দিচ্ছে আইনের পড়ুয়ারা। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইন পড়ে রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে ডিল করতে শিখছেন আইন পড়ুয়া পাহাড়ীরা। ফলে মার খাচ্ছে নিজেদের প্রথাগত আইনগুলো। পার্বত্য অঞ্চলে শুধুমাত্র অন্যান্য অঞ্চলের মতো ক্রিমিনাল ল এপ্লাই হবার কথা। সিভিল ম্যাটার বা সিভিল ল এর বিষয়ে ডিল করার কথা হেডম্যান, কারবারীদের, জাজের কোন এখতিয়ার থাকার কথা না। তারপরও পার্বত্য অঞ্চলে সিভিল ও ক্রিমিনাল ল- উভয় ম্যাটার ডিল করে যাচ্ছেন রাষ্ট্রের বিচারকবৃন্দ।
জাতীয় আইন পড়ে জাতীয় আইনের পাশাপাশি আমাদের প্রথাগত আইনের বিষয়ে সবচেয়ে সোচ্চার করার কথা পাহাড়ী আইন পড়ুয়াদের। অথচ দু-একজনকে দেখেছি বিয়ে সনদের পক্ষে কথা বলতে। রাষ্ট্রের সফল মিশন আর কাকে বলে!
এ বিয়ে সনদ কোন বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। এটির বিরুদ্ধে আমাদের সবার অবস্থান হওয়া উচিত। প্রথাবিষয়ে সবার ভাবাদর্শ এক হওয়া উচিত। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা উচিত। তার চেয়ে দেখলাম, এটিকে নিয়ে প্রতিযোগিতা করে বিতর্ক হতে যাচ্ছে শুনে মর্মাহত হলাম।
0 Comments