গ্রামে গ্রামে কিংবা পাড়ায় এখনও কার্বারী আছে, হেডম্যান আছে। আছে নিজস্ব উপায়ে বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ। নিজেদের জীবন কীভাবে চলছে সেই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আছে আমাদের। সেইজন্য বৃটিশ, পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশেও আমাদের প্রথা-রীতি-নীতিকে স্বীকার করা হয়েছে আইনের মাধ্যমে। আমাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে বড় ধরণের ক্রিমিনাল এক্টিভিটি ছাড়া যাবতীয় পারিবারিক ও ভূমি সংক্রান্ত অর্থাৎ দেওয়ানি প্রকৃতি বিষয়াবলিতে রাষ্ট্রের আইন বা আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার দরকার নাই। এ ধরণের সমাজকাঠামোকে স্বীকার করে আইনের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এমন একটি আইন হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন,১৯০০।
২০০৬ সালে খাগড়াছড়ি যুগ্ম জেলা জজ মারমাদের প্রথাগত আইনকে বাদ দিয়ে হিন্দুদের দায়ভাগ আইন প্রয়োগ করে এক মারমা বিধবার উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য রায় দিয়েছিলেন। পরে রীট করা হলে হাইকোর্ট বিভাগ সার্কেল চীফ ও হেডম্যানের সাথে পরামর্শ করে মারমা প্রথাগত আইন প্রয়োগের নির্দেশ দিয়ে সেই রায় বাতিল করে। ওই মামলায় এখনও ১৯০০ রেগুলেশন বলবৎ আছে তা আমরা নতুন করে জানতে পারি। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে মারমা প্রথাগত আইনের অনুসারে কন্যাদেরও ওয়ারিশ হবার সুযোগ অব্যাহত থেকে যায়।
এ আমাদের নিজস্বতাকে স্বীকার করে আইন হওয়াটাকে বাতিল করতে উঠেপড়ে লেগেছে একদল মানুষ। ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ির দুইজন এ রেগুলেশনকে বাতিলের জন্য হাইকোর্টে দুটি রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছে। শুনানী হবার কথা গত ১৯ অক্টোবর। পরে সেই শুনানীর দিন পিছিয়েছে।
একটু ব্যাখ্যায় যাই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ যেটি সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০ নামে পরিচিত, সেটি ১৯০০ সালে প্রণয়ন করা আইন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও কার্যকর। এখনও বলবৎ ও কার্যকর আছে। যেমনটি ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি কিংবা ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির মতোই এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে সিএইচটি রেগুলেশন বহাল আছে। সময়ে সময়ে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী সংশোধনী এনেছে ঠিকই, তবে মূল স্পিরিটটা প্রায় আগের মতোই আছে। সর্বশেষ ২০০৩ সালে এ রেগুলেশনের ধারা ৮ সংশোধনী আনা হয়। অর্থাৎ আগে ডেপুটি কমিশনার ও বিভাগীয় কমিশনারের ওপর বিচারিক ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল, সেটা ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের অধীনস্থ বিচারিক কর্মকর্তাদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এবং ২০১৩ সালে গেজেটের মাধ্যমে বিধি ৪১ ও ৪২ সংশোধন করা হয়। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে জুম চাষ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) এর বদলে পার্বত্য জেলা পরিষদকে দেওয়া হয়।
এ রেগুলেশন এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম কীভাবে চলবে, সেটার অনেকটা এ রেগুলেশনে আছে।
এ রেগুলেশনের ১৮ ধারার অধীনে সময়ে সময়ে সরকার কর্তৃক জারিকৃত বিভিন্ন বিধি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশাসন পরিচালিত হবে, এমনটি বলা আছে। এ রেগুলেশনের বিধিগুলোর অনেকাংশে জুড়ে রয়েছে দেওয়ানী বিচারব্যবস্থাকে ঘিরে। বিশেষত ভূমির প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। আর এ ভূমি সংশ্লিষ্ট হেডম্যানের কথা বলা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ রেগুলেশনে যে, আমাদের স্ব স্ব ট্রাইবালদের প্রথাগত কোন আইন হতে উদ্ভূত কোন সমস্যার জন্য হেডম্যান ও সার্কেল চীফ মিমাংসা করতে পারবেন। অর্থাৎ এ রেগুলেশনে ফলে আমাদের প্রথাগত আইনকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে প্রথাগত আইনে হেডম্যান ও সার্কেল চীফ যেটাই বিচার করবেন, সেগুলো স্বীকৃতি পাবে। এবং সেগুলো বাস্তবায়িত হবে।
এ রেগুলেশন এখনও বহাল আছে। খাগড়াছড়িতে বিশেষত ভূমির ক্ষেত্রে এ রেগুলেশন প্রয়োগ হচ্ছে। প্রায় ২০টির মতো দেওয়ানী মামলা গেঁটে আমি পেলাম, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দেওয়ানী আদালতে যে যে বিষয়গুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি,১৯০০ এর বিভিন্ন ধারা ও ১৮ ধারার অধীনে বিধিগুলো প্রয়োগ হচ্ছে-*
১. জমি ক্রয়-বিক্রয়ের এভিডেভিড বা হলফনামা লেখাতে
২. ওয়ারিসন সনদ (উত্তরাধিকার সনদ) ইস্যু করতে
৩. কোন মামলা-মোকদ্দমায় দলিল রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত প্রসঙ্গে মামলা খারিজ করতে
৪. ডিসির অনুমতি নিতে
৫. নামজারী মামলার আরজিতে
৬. বিধি ২ অনুযায়ী সাক্ষী ছাড়া পক্ষদ্বয়ের মৌখিক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বিচারকার্য পরিচালনা করতে বা মামলা খারিজ করতে।
৭। জমি বন্ধক প্রদান বন্ধে অনাপত্তিপত্রেও এ রেগুলেশনের থাকা বিভিন্ন বিধি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
• আরও অনেকক্ষেত্রে এ রেগুলেশনের প্রয়োগ থাকতে পারে।
জমি বিক্রয়ের এভিডেভিড বা হলফনামা তৈরিতেও এ রেগুলেশনকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওয়ারিসন সনদ (উত্তরাধিকার সনদ) জেলা প্রশাসক থেকে দেওয়া হয়, সেটাও এ সিএইচটি রেগুলেশন কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ডিসিরা দিতে বাধ্য। ওয়ারিসন সনদ ইস্যু করার বিজ্ঞপ্তিতে ডিসি স্পষ্ট করে লিখেন যে, 'পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯০০ এর ধারা ৭ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ওয়ারিসন সনদ দেওয়া হল। ' কোন কোন মামলা খারিজ করা হয়েছিল এ রেগুলেশনের ৮/৯ বিধিকে রেফারেন্স টেনে। দেওয়ানী একটা মামলায় বিধি ২ কে রেফারেন্স টেনে খারিজ করা হয়েছিল। কেউ কেউ আরজিতেও এ রেগুলেশনকে রেফারেন্স টেনে লিখেন।
ফলে এটি বলা যায় যে, ১৯০০ সনের প্রণীত এ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (কোন কোন জায়গায় ডিসির আদেশ বা জজের রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধান, ১৯০০ লেখা আছে) এখন চলছে। তাই ১৯০০ রেগুলেশন কোনভাবে মৃত বা অচল আইন নয়। বরং এখনও আমাদের কাছে জীবিত ও সচল আইন হিসেবে রক্ষাকবচ হয়ে এ রেগুলেশন আছে। এ রেগুলেশন বাতিল হলে আমাদের হেডম্যান, সার্কেল চীফ, প্রথাগত আইন, পার্বত্য চুক্তি, জেলা পরিষদ থেকে শুরু করে আমাদের যাবতীয় অনুষঙ্গ হারিয়ে যাবে। আমাদের অস্তিত্ব আর থাকবে না।
খাগড়াছড়ি থেকে অজ্ঞাত দুজন কর্তৃক রিভিউ পিটিশনের উপর রাষ্ট্রপক্ষের এটর্নি জেনারেলের ডিফেন্ড করার কথা। চূড়ান্ত রায়ের উপর কোনভাবেই আর রিভিউ হবার কথা না। সেটার উপর যদি আবার রিভিউ পিটিশন করা হয় এবং এটর্নি জেনারেল যদি এ রেগুলেশনের শব্দ, বাক্য ও রাজা শব্দটিকে বাদ দিয়ে হলফনামা দিয়ে আবেদন করেন, তাহলে আমাদের বুঝতে বাকি নেই, রাষ্ট্রপক্ষের সর্বোচ্চ আইনজীবী বরং রিভিউ পিটিশনকারীদের পক্ষ নিয়েছেন।
এখনও এ রেগুলেশনের কারণে প্রথাগত প্রথা, আইন-রীতি-নীতির কারণে আমরা ভূমির উপর বেঁচে আছি। কয়েকদিন পর এ রেগুলেশন বাতিল হলে 'দলিল যার, জমি তার' হলে আমাদের কোন ভূমিই থাকবে না। এমনিতেই খাগড়াছড়ির মারমারা রেকর্ডীয় অনেক জায়গা চাকরির ঘুষ দিতে কিংবা বিল্ডিং বানাতে বিক্রি করে শেষ করে দিয়েছে। তার উপর এ রেগুলেশন বাতিল হলে আমাদের আর অস্তিত্ব থাকবে না।
........................................
আমরা কোনকিছু বিপদ থেকে রক্ষার জন্য তাবিজ পরি। এ তাবিজ আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে বলে আমরা মনে করি। তাবিজ থাকলে মন দৃঢ় হয়। অকুশল ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারি। বিশ্বাসে থাকা অনেকাংশই এ তাবিজ আমাদের অস্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আর আমাদের বাস্তবে থাকা সিএইচটি রেগুলেশনের নামে রক্ষাকবচটি হারিয়ে যেতে বসেছে, এটা কি আমরা দেখছি না? আর কতদিন আমরা এ রক্ষাকবচকে না জেনে থাকব?
0 Comments